| ২৬ জুন ২০২০
গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে ১৯৭৫ থেকে ২০০০ পযর্ন্ত বিশ্বে প্রবীণ জনসংখ্যা ৩৬ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ কোটিতে দাড়িঁয়েছে।
অর্থাৎ, প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার ২.৬৮ শতাংশ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার হিসাব অনুসারে ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রবীণদের সংখ্যা ৯০ থেকে ১০০ কোটিরও বেশি বৃদ্ধি পাবে ।
অর্থাৎ, ৫.৫৬ শতাংশের চেয়েও বেশি হবে । উন্নয়নশীল দেশেরও একই বাস্তবতা।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে প্রবীণের সংখ্যা ৬০ লক্ষ যা ১৯১১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িঁয়েছে ১ কোটি ১৩ লক্ষে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ৪.৪১ শতাংশ (প্রায়)।
প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরে প্রবীণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাধর্ক্য বতর্মান বিশ্বের অন্যতম সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত। প্রবীণ সমস্যা – স্বাস্থ্যগত, কর্মঅক্ষমতা, পরিবার বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব ইত্যাদি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বৈশ্বিক নানা পরিকল্পনার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে বতর্মান সরকার নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, প্রবীণ নীতিমালা, ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩। যদিও এসব নীতিমালা এবং আইন সমস্যার তুলনায় নামমাত্র।
সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাংলাদেশে প্রবীণ ব্যাক্তিরা এখনো যৌথ পরিবারের অংশ হিসেবে থাকেন। বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাসে বসবাস করার মতো মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি।
কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের ধারণাটা ক্রমেই আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। এই পরিবর্তন কাঠামোগত। কিছুটা ধারণাগতও। আধুনিক যুগের অগ্রগতিতে পরিবারের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য প্রকৃতপক্ষে ম্লান হয়ে গেছে।
পাশ্চাত্যকরণ ক্রমশ বাড়ার সাথে সাথে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার সংবেদনশীল বন্ধন কমে আসছে। আধুনিক পরিবার আর আগের দিনের মতো ‘যত্নদাতা’ থেকে যায় না, আগে যেমন পরিবার তার সদস্যদের ‘জন্ম থেকে মৃত্যু’ পযর্ন্ত ‘যত্নশীল’ হয়ে থাকত। বতর্মানে উচ্চাকাঙ্খা, গ্রাম ছেড়ে শহর অভিমুখে যাত্রা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন, ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ অর্জন ইত্যাদির প্রভাবে যৌথ পরিবারগুলো এখন একক পরিবারে পরিনত হয়েছ।
তরুন যুবকরা তাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে সাথে রাখার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়না। পরিবারের বয়স্করাও কখনো কখনো সাংস্কৃতিক পরির্বতনকে মেনে নিতে চান না। ফলে শুরু হয় নবীন প্রবীণ পারিবারিক দ্বন্দ্ব ।
এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে সামাজিক ও রাস্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। কখনও বা বয়স্ক সদস্যদের কাছে রাখার বিষয়টিকে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান নয় বোধে বয়স্ক ব্যাক্তিরা বঞ্চিত হতে থাকেন পরিবারের হাসি আনন্দ সুখ দুখ থেকে। ফলত তারা পরিবারে একা হয়ে যান।
কখনো কখনো নিজেরাই এই একাকীত্ব মেন নেন। কখনো কখনো তাদের ঠাঁই হয় রাস্তায় বা পরিবারের গোত্রীয় সদস্যদের কাছে; কখনো কখনো বাধ্য হয় বৃদ্ধাশ্রমে যেতে । এদিকে রাস্ট্রীয় কাঠামোর দূবর্লতা বা প্রবীণ অধিকার রক্ষা আইনের ব্যবহারের অভাবে নাগরিক অধিকার; রাস্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠী।
প্রবীণদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন নারীরা।
আমাদের দেশে জন্ম থেকে নারী অধস্তন। তাদের জীবন শুরুর থেকেই প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। প্রথমে কন্যা সন্তান হিসাবে, তারপর বিবাহিত মেয়ে, বয়স্ক নারী এবং শেষ পর্ন্ত বিধবা। আর যারা অবিবাহিত বা স্বামীর সংসার করেন না তাদের বিষয়টি উল্লেখযোগ্যও নয়। আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজে দু’টি বিষয়ে তাদেরকে আরো অবহেলিত করে রেখেছে।
প্রথমত: পরিবারিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার স্টোর-হাউজ, দ্বিতীয়ত: ছোট ছোট সন্তানের যত্ন নেওয়া। টেকনোলজীর যুগে নতুন প্রজন্ম প্রবীণদের জ্ঞানের প্রশংসা করে না এবং বয়স্ক নারীদের উপর কম নির্ভর করে।
বরং তাদের এই জ্ঞানকে কুসংস্কার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং বতর্মান টেকনোলজীতে পারদর্শী অভিজ্ঞ ব্যক্তির উপর নির্ভর করে তরুন প্রজন্ম। তাই তারা ছোট পরিরারের দিকে আকৃষ্ট হয়ে আলাদা থাকার প্রয়াস করে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে একা পৈত্রিক বাড়িতে বা কোন আত্মীয়ের কাছে বা বৃদ্ধাশ্রেমে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়।
বাংলদেশে প্রবীণ নারী-পুরুষের আর্থ-সামাজিক জীবন চিত্র নিয়ে গবেষণার অভাব রয়েছে। এশীয় মহাদেশের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ভারতে ১৩.৭ শতাংশ বৃদ্ধ পুরুষ এবং ৩.৫ শতাংশ নারী তাদের পুত্রবধু দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ৩৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধ স্বামী বলেছেন, তারা তাদের স্ত্রীকে নির্যাতন করেছেন। ৮১.৪ শতাংশ বয়স্ক ব্যাক্তি বিবাহিত ব্যাক্তি ছিলেন।
এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ নারীর কোনও ব্যক্তিগত উপার্জন ছিল না এবং তারা আর্থিকভাবে পরিবারের উপর নির্ভরশীল ছিল। ভারতে পুত্রদ্বারা নির্যাতন বশি হয়েছে। অনাথ এবং বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্তা বা অবিবাহিত, বা স্বামীর বহুস্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত নারীর অবস্থান হয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে। যেখানে নারীর বসবাসের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।
উল্লেখ্য যে, যৌথ পরিবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে গ্রামীণ বয়স্ক নারীরা বেশি শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে।
নিরাপত্তা, সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা, অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণসহ তাদের অবস্থান একবারেই শোচনীয়। বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের রাস্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার স্বল্পতা ও গলদ রয়েছে। নেই তেমন কোন জনসচেতনতা কর্মসূচি।
বতর্মানে কিছু কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে সেখানেও রয়েছে নানা জটিলতা। এছাড়াও কিছু কিছু কর্মসূচি। একেবারেই শুরুর দিকে রয়েছে।
এখন সময় এসেছে প্রবীণ সুরক্ষা আইনের প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা বোধ তৈরির। বর্তমান প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিকতা ও সামাজিক পরিকাঠামোর অভাব এবং রাস্ট্রীয় দিক নিদের্শনার যথাযথ প্রয়োগের অভাব, আইনের ফাঁকে দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী শিকার হচ্ছে নানা রকম বঞ্চনার। প্রাকৃতিক, সামাজিক, দুর্যোগে প্রবীণ অধিকার সুরক্ষার কর্মসূচির বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।