| ১২ আগস্ট ২০২০
লেখক পরিচিত: শক্তি আচার্য ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার বিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ । বাবার চাকরীসূত্রে লেখাপড়ার সূচনা খুলনায় । পরবর্তীতে ঢাকায় । স্কুল নারী শিক্ষা মন্দির, কলেজ শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় , গ্র্যাজুযেশন ইডেন মহিলা কলেজ। পড়ার মধ্যেই বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের চাকরীতে যোগদান। দীর্ঘ চাকরীজীবন শেষে ২০১০ এ অবসর গ্রহণের পর শ্বশুর বাড়ি সুনামগঞ্জে অবস্থান।
যখন থেকে বর্তমানের চেয়ে অতীত স্মৃতিগুলি মনের কোণে মূল্যবান জায়গা দখল করে চলেছে তখন থেকেই অনুধাবন করতে পেরেছি বয়স বাড়ছে । আর এখন তো বিশ্বব্যপি একটা অণুজীবের তান্ডবে ভীত হয়ে আমরা গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছি ।আর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা-দুর্ঘটনার স্মৃতিকাতরতায় ভুগছি ।
প্রথম যে ঘটনাটা হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তা হচ্ছে চৌষট্টির দাঙ্গা । দিনটি ছিল পৌষসংক্রান্তির । আগের রাত থেকেই মা পিসিমা পিঠার আয়োজনে ব্যস্ত , আমরা ছোটরা ভাইয়ের ঘুড়ি ওড়ানোর সরঞ্জাম ঠিকঠাক করে ওকে সাহায্য করছি এমন সময় খবর এলো ঠাঁটারিবাজার, শাখারীপট্টি, তাঁতিবাজার ইতিমধ্যেই রক্তাক্ত । আমাদের সেই বাসায় অনেকগুলি পরিবারের বাস ছিল। একে একে সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘর ছাড়লো। বাবা অফিসে , পাশের বাড়ি থেকে উনার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলো। বেশ খানিকটা সময় বাবা এলেন উনার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে । আমরা তখন ভয়ে জড়সড় , বাবা সবাইকে আশ্বাস দিয়ে নিয়ে গেলেন সেই বন্ধুর বাসায় । দাঙ্গা চলাকালীন সময়টা আমরা সেখানেই অতিবাহিত করলাম।
দাঙ্গা শেষে ঘরে ফিরে আমরা দেখেছিলাম পচনধরা পিঠার সামগ্রী ।
আমরা বোনেরা পড়তাম “নারি শিক্ষা মন্দির” স্কুলে । স্কুলে গিয়ে পেলাম এক মর্মন্তুদ সংবাদ । স্কুলের একজন কর্মনিষ্ঠ অফিসকর্মী অবনীবাবু ছুটির মধ্যেও স্কুলে এসে নিজের কাজে নিমজ্জিত ছিলেন । জগদীশ স্যার নামে একজন শিক্ষকও ওখানে ছিলেন। এমন সময়ে দাঙ্গাকারীরা সোল্লাস জয়ধ্বনি দিতে দিতে স্কুলে ঢুকে দুজনকেই আঘাত করে পালিয়ে যায় ।অবনী বাবু সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন, জগদীশ স্যার প্রাণে বেঁচে যান । যখন দাঙ্গাকারীরা ঢুকছিল তখন একটি কুকুর বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে এক কোপে তার একটি পা কেটে নিয়েছিল।
অবনী বাবুর সাথে তাদের কোন ব্যাক্তিগত শত্রুতা ছিলনা তবুও তাঁকে মেরে ফেলার মধ্যে কি যে পৈশাচিক আনন্দ! যতবার ঐ তিনপেয়ে কুকুরটার দিকে তাকাতাম ততবারই দাঙ্গার বিভৎসতা উপলব্ধি করতাম।
আমাদের স্কুলে বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকাই হিন্দু ধর্মের লোক ছিলেন । এরপর অনেকেই ভারত চলে যান। প্রায় শিক্ষক শূন্য স্কুল আমাদের লেখাপড়ায় যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। আমাদের প্রধান শিক্ষকের পদটি রদবদল হতে হতে মিসেস হোসনে আরা শাহেদের হাতে এসে স্থিতিশীল হলো। তিনি বেশ কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ দিলেন।
পঁয়ষট্টিতে হলো পাকভারত যুদ্ধ । আমরা তখন ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের বাসন্দা। যুদ্ধের প্রধান রণাঙ্গন ছিল পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে । তাই আমাদের উপর তেমন ছাপ ফেলে নি। তবুও দুইটি দেশের যুদ্ধ ব্যাপারটা বুঝেছিলাম ব্ল্যাক আউট এবং রেডিও প্রচারিত সংবাদের মাধ্যমে ।
ছেষট্টিতে হলো আমাদের একটি পারিবারিক বিপর্যয়। বাবা অফিসে স্ট্রোক করলেন। হাসপাতাল কাকে বলে সেই প্রথম দেখেছি। বাবা বাসায় ফিরলেন পঙ্গু অবস্থায় । তখন থেকে আমাদের পারিবারিক সংগ্রামের শুরু।
আমি ঊনসত্তরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলাম। ঢাকার অদূরে ডেমরায় আঘাত হানলো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। আমাদের পরীক্ষা পিছিয়ে গেল এক মাস।
সত্তরে এলো নির্বাচন । আমরা তখনো ভোটার নই , তবে নির্বাচন মানুষের আশাবাদ আমাদেরও আন্দোলিত করেছে। হতাশার পথ বেয়ে আসলো মুক্তিযুদ্ধ। আবার ঢাকা শহর রক্তে ভাসলো। অন্যান্য ঢাকাবাসীর সাথে আমরাও ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সেই প্রথম শুরু হলো অন্তরীণ জীবন আর স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা ।
এবারের শত্রু মহামারী , যার প্রতি পক্ষ সমগ্র বিশ্ব। তাই ভাবি জীবনটা কেটে গেল নানা বিপর্যয়ের ধাপ পেরোতে পেরোতে । তবুও মনের কোণে আশার প্রদীপটা নিভতে দেবনা , নিজেকেই বোঝাই একদিন যেমন করে স্বাধীনতার আলো দেখবো বলে অপেক্ষা করেছিলাম, আজও তেমনি মহামারী মুক্ত পৃথিবী দেখবো বলে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবো। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের কবিতার বামির মত আমাকে যেন বলতে না হয় “হারিয়ে গেছি আমি “।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ||||||
২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ |
৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ |
১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ |
২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ |
৩০ | ৩১ |